সন্তান জন্মদানের যে পদ্ধতিতে সার্জারি বা কাটাকুটির দরকার হয় তাকে আমরা সবাই ‘সিজার’ নামে জানি। এর মেডিকেল টার্ম সিজারিয়ান সেকশন বা সি-সেকশন। যেসব কারণে সি-সেকশন এর মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেয়ার প্রয়োজন হতে পারে এবং সি-সেকশন কিভাবে করা হয়, করার পরে কী ধরনের যত্ন দরকার হয় এসব নিয়ে এই আর্টিকেল।
বেশিরভাগ মা-ই চান নরমাল ডেলিভারি বা প্রাকৃতিক নিয়মে সন্তান জন্ম দিতে। কিন্তু অনেক সময় পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়ায় যে সি-সেকশন করানো ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। তাই গর্ভাবস্থায় নরমাল ও সি-সেকশন দুই ধরনের ডেলিভারি পদ্ধতি সম্পর্কে জেনে রাখা ভালো।
আমেরিকায় প্রায় ৩২ শতাংশ শিশু সিজারের মাধ্যমে জন্মগ্রহণ করে। বাংলাদেশেও সি-সেকশনের সংখ্যা কম নয়। তবে বাংলাদেশের বেশিরভাগ সি-সেকশনই ‘অপ্রয়োজনীয়’ বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে।
কোন পরিস্থিতিতে সি-সেকশন করতে হয় সেটি এখানে সহজে বুঝিয়ে লেখার চেষ্টা করব। তবে মনে রাখবেন, কোন পদ্ধতিতে সন্তান জন্ম দেবেন সেটা আসল বিষয় নয়। যেভাবেই হোক না কেন, মা এবং শিশু দুজনের জন্য কোনটা ভালো ও নিরাপদ সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
সিজার কী
সি- সেকশন বা সিজারিয়ান সেকশন হলো অপারেশনের মাধ্যমে (তলপেট এবং জরায়ুর একটা নির্দিষ্ট অংশ কেটে) সন্তান জন্মদান পদ্ধতি। যেসব মায়েরা গর্ভাবস্থায় বেশ ঝুঁকিতে থাকে (হাই ডায়বেটিস বা অন্য কোনো মারাত্মক রোগ) তাদেরকে ডাক্তার সি-সেকশন করার পরামর্শ দেন। আবার ধরুন, যদি মায়ের পেটে শিশু উল্টো হয়ে থাকে অর্থাৎ মাথার পরিবর্তে বাচ্চার পা জরায়ুর দিকে থাকে এবং প্রসববেদনা শুরু হওয়ার আগে শিশুর অবস্থান উল্টানোর সম্ভাবনা অর্থাৎ মাথার দিক জরায়ুর দিকে আসার সম্ভাবনা না থাকে সেক্ষেত্রে সি-সেকশন করা ছাড়া আর কোনো নিরাপদ উপায় থাকে না। অনেক সময় মায়ের পেলভিক হাড়ের আকৃতি, স্বল্প-উচ্চতা, এইরকম নানাকারণেও সি-সেকশন হয়।
জরুরি সি-সেকশন
যে সিজার মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে করা হয় তাকে ইমারজেন্সি সি-সেকশন বলে।এরকম অবস্থায় সাধারণত সি-সেকশন না করালে মা ও শিশু দুজনেরই জীবন/ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকে।
সাধারণ সি-সেকশন
কিছু হাসপাতাল এখন জরুরি সি-সেকশনের বাইরে অন্য এক ধরনের সি-সেকশনের ব্যবস্থা করে থাকে যা আগে থেকেই পরিকল্পিত। এই ধরনের সিজার করানোর জন্য পরিবেশ নিরিবিলি এবং নীরব রাখা হয়।সিজার করার সময় মায়ের বুক আর কোমরের মাঝামাঝি অংশে এমন একটা পর্দা রাখা হয় যেটা দিয়ে অন্যপাশে দেখা যায়,যা দিয়ে সন্তান জন্মানোর মুহুর্তও মা নিজের চোখে দেখতে পারে।কিছু পর্দায় ছিদ্রও রাখা হয়, যাতে শিশু জন্মের পরপরই মায়ের হাতে দিয়ে দেয়া যায়।
কিন্তু অবশ্যই পেটের যে অংশে সিজার করা হচ্ছে সেটা আলাদা আর সুরক্ষিত রাখা হয় যাতে সিজার করতে সুবিধা হয় এবং কোনো জীবাণুর সংস্পর্শে এসে ইনফেকশন না হয়ে যায়।
এই ধরনের সি-সেকশনের সময় হার্ট মনিটরিং সিস্টেম বুকের পরিবর্তে পিঠের দিকে রাখা হয় যাতে বুক খালি থাকে। যাতে বাচ্চা জন্মের পর সরাসরি মা বুকে জড়িয়ে রাখতে পারে। তাছাড়া এক বাহু/হাত একদম খালি রাখা হয়। কোনো ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয় না যাতে মা হাত দিয়ে সহজেই জন্মের পর শিশুকে জড়িয়ে ধরতে পারে এবং বুকের দুধ পান করাতে পারে।
এক্ষেত্রে মায়ের পরিচিত একজন, হতে পারে শিশুর বাবা বা নানী বা অন্য কেউ, যে ডেলিভারির সময় মায়ের পাশে থাকা দরকার বলে মা মনে করেন বা থাকলে মা সাহস পাবেন এমন কেউ তার সাথে থাকতে পারেন। মানুষ বাচ্চা জন্ম দেয়াটাকে অনেক কঠিন মনে করে।বিশেষত যারা প্রথমবার মা হয়,সেক্ষেত্রে এই পদ্ধতিগুলো মায়ের ভয় দূর করে দিতে সাহায্য করে।
কেন সি-সেকশন করাতে হয়
ডেলিভারি ডেটের আগেই ডাক্তার সি-সেকশন করানোর পরামর্শ দিতে পারেন। যার অর্থ হলো ডাক্তার পরিকল্পিতভাবে সি-সেকশন করাবেন। বিশেষ শারীরিক অবস্থার কারণে সিজার করানোর প্রয়োজন হয়। যেমন:
চিকিৎসাধীন অবস্থা: মা যদি কোনো জটিল রোগে আক্রান্ত থাকে (হৃদরোগ,ডায়বেটিস, উচ্চরক্তচাপ বা কিডনির রোগ) যেগুলো নরমাল ডেলিভারিকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। এইসব ক্ষেত্রে সিজারিয়ান পদ্ধতি তুলনামূলক নিরাপদ।
সংক্রমণ: যদি মায়ের অনিয়ন্ত্রিত এইচআইভি অথবা যৌনরোগ থাকে (যেমন-হার্পিস) তাহলে পরিকল্পিতভাবে সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে সন্তান জন্মদান করা জরুরি। কারণ এই দুই রোগই নরমাল ডেলিভারির সময় শিশুর দেহে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
তবে এইচআইভি যদি নিয়ন্ত্রিত হয় অর্থাৎ রক্তে এইচআইভির পরিমাণ যদি খুবই কম হয় যা সাধারণ পরীক্ষায় ধরা পড়েনা, সেক্ষেত্রে নরমাল ডেলিভারি করানো যেতে পারে।
শিশুর স্বাস্থ্য: গর্ভের শিশুর কোনো অসুস্থতা অথবা পরিবেশগত কারণে বা উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া কোনো রোগ থাকলে হয়ত নরমাল ডেলিভারি কঠিন বা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় সিজার করানো।
বড় আকারের শিশু: কখনো কখনো শিশু আকারে অপেক্ষাকৃত বড় হতে পারে (যা ম্যাক্রোসোমিয়া নামক একটি মেডিকেল কন্ডিশনের কারণে হয়ে থাকে), সেক্ষেত্রে যোনীপথে স্বাভাবিক জন্মদান প্রক্রিয়া সম্ভব হয় না বা ঝুঁকিপূর্ণ হয়। মায়ের হাই ডায়বেটিসের কারণেও বাচ্চা আকারে বড় হতে পারে।
শিশুর পা যোনীর দিকে থাকলে: যদি শিশুর মাথার দিকের পরিবর্তে পায়ের দিক যোনীপথের দিকে থাকে এবং উল্টানোর কোনো সুযোগ না থাকে সেক্ষেত্রে ডাক্তার সিজারিয়ান সেকশন করার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
একাধিক শিশু: গর্ভে যদি একের অধিক শিশু থাকে এবং একজন বা উভয় শিশুর মাথা যদি নিচের দিকে অর্থাৎ যোনীপথের দিকে না থাকে তাহলে সিজারিয়ান সেকশন করানোর সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
গর্ভফুলের সমস্যা : গর্ভফুল (Placenta) যদি জরায়ু মুখ বন্ধ করে রাখে, যেখান থেকে শিশু বাইরে বের হবে সেই পথ যদি আটকে রাখে,তাহলে শিশু জন্মানোর ক্ষেত্রে সিজারিয়ান সেকশন অপেক্ষাকৃত নিরাপদ।
ফাইব্রয়েড বা টিউমার: যদি মায়ের জরায়ুতে বড় টিউমার হয় যা ফাইব্রয়েড নামে পরিচিত সেটি যদি জন্মনালী বা যেটা দিয়ে শিশু বের হবে তা বন্ধ করে দেয় এবং তলপেটে যদি আগে থেকে কোনো আঘাত বা ইনফেকশন থাকে তাহলে সিজারিয়ান সেকশন করানো জরুরি।
মায়ের বয়স: বয়স বেশি হয়ে গেলেই সিজার করতে হবে বিষয়টি এমন নয় কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে শারীরিক সক্ষমতা কমতে থাকে এবং অসুবিধা বাড়তে থাকে, সেক্ষেত্রে সিজার করানোই নিরাপদ।
মায়ের ওজন: মায়ের ওজন যদি বেশি হয় তাহলে সিজার করানোর প্রয়োজনীয়তা বেড়ে যায়।কারণ ওজন বাড়ার সাথে সাথে কিছু রোগ শরীরে তৈরি হয় যেমন ডায়াবেটিস, এবং অতিরিক্ত ওজনের কারণে নারীর প্রসববেদনা দীর্ঘ সময় ধরে হয় বলে অপারেশন করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকেনা।
অন্যান্য জটিলতাসমূহ : যদি মায়ের প্রি- এক্লাম্পসিয়া (preeclampsia) ( উচ্চ রক্তচাপ যা গর্ভধারণের কারণে হয়) বা এর পরবর্তী জটিল ধাপ এক্লাম্পসিয়া হয়, এই ক্ষেত্রে চিকিৎসা কোনো কাজে আসেনা।এই পরিস্থিতিতে সিজারিয়ান সেকশন ডেলিভারিকে সহজ করে দেয়।
আগে সিজার করে থাকলে: প্রথম সন্তান সিজারের মাধ্যমে হয়ে থাকলে পরবর্তী সন্তানও সিজারের মাধ্যমে হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। কিন্তু প্রথমবার সিজারিয়ান সেকশন করার পরও দ্বিতীয় সন্তান নরমাল ডেলিভারি করা সম্ভব। এই অবস্থাকে বলা হয় VBAC( Vaginal birth after C-section)। প্রথমবার যে সমস্যার কারণে সি সেকশন করিয়েছিলেন সেই রোগ বা সমস্যা যদি কেটে যায় তাহলে ডাক্তাররা নরমাল ডেলিভারি করানোর অনুমতি দিয়ে থাকেন।
এছাড়াও কিছু কারণ রয়েছে যা একজন প্রসূতির প্রসববেদনা শুরুর আগ পর্যন্ত বোঝা যায়না।যে কারণগুলো অপরিকল্পিত বা হঠাৎ করে সিজারিয়ান সেকশন করানোর জন্য দায়ী।
প্রসব শুরু হচ্ছে না: ২৪-২৫ ঘণ্টা ধরে প্রসববেদনা সহ্য করা বা পানি ভেঙে যাওয়ার পরেও বাচ্চা বের হয়ে আসার কোনো লক্ষণ যদি দেখা না যায় তখন চিকিৎসকেরা সি-সেকশন করার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
প্রসবে দেরি হওয়া: অনেক সময় প্রসববেদনা শুরুর প্রথমদিকে জরায়ুমুখ ৪ থেকে ৫ সেন্টিমিটার খোলার পরে হঠাৎ করে আর খুলতে চায়না। এক্ষেত্রে পিটোসিন (এক ধরনের মেডিসিন) ব্যবহার করে জরায়ুমুখ খোলার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে যে কারণে কন্ট্রাকশন বা জরায়ুমুখ খোলা বন্ধ হয় তা হলো শিশুর মাথা অতিরিক্ত বড় হওয়া। এক্ষেত্রে সিজারিয়ান সেকশন করানো ছাড়া উপায় থাকেনা।মায়ের অতিরিক্ত শারীরিক ক্লান্তি অথবা শিশুর অস্বাভাবিক অবস্থা : লম্বা সময় ধরে প্রসববেদনা বা অন্যান্য কারণে মা যদি বেশি ক্লান্ত হয়ে যান এবং পরিমাণমতো অক্সিজেন না পাওয়ার কারণে গর্ভের শিশু যদি অসুস্থ (হার্টবিট বাড়া কমা) হয়ে যায়–এমন লক্ষণ দেখলে ডাক্তাররা জরুরি ভিত্তিতে সিজারিয়ান সেকশন করিয়ে ফেলেন।
নাড়ি স্থানচ্যুত হওয়া: নাভিরজ্জু বা নাড়ি যদি জন্মনালীতে শিশুর আগে চলে আসে তাহলে চাপের কারণে এটি সংকুচিত হয়ে যেতে পারে যা শিশুর শরীরে অক্সিজেন সরবরাহে বাধা দেয়। এক্ষেত্রে সিজারিয়ান সেকশনের সহায়তা নেয়া প্রয়োজন।
জরায়ু ছিঁড়ে যাওয়া : জরায়ু যদি অতিরিক্ত চাপে ছিঁড়ে যায় তবে সি-সেকশন করাতে হয়।
সিজারের সময় কী হয়
অধিকাংশ হাসপাতাল চেষ্টা করে ঘরোয়া পরিবেশে সিজারিয়ান সেকশন সম্পন্ন করতে। যেখানে গর্ভবতী মা অপারেশন চলা অবস্থায় জেগে থাকবে (অবশ্যই শরীরের নিচের অংশ অবশ রাখা হয়) স্বামী বা কাছের কেউ মায়ের সাথে থাকবে, সেই সাথে শিশু জন্মের পরপরই মায়ের সাথে দেখা করা, জড়িয়ে ধরা এবং সম্ভব হলে দুধ পান করানোর সুযোগ করে দেয়। যদি না মা বা শিশুর অন্য কোনো সমস্যা না থাকে।
সিজার করতে সময় লাগে খুবই কম। মোটামুটি দশ মিনিট বা আরো কম সময়ের মধ্যেই সিজার করা যায়। তবে আরো ৩০ মিনিট সময় লাগে বাকিসব কাজ, যেমন সেলাই সারতে।
সিজারিয়ান সেকশন পরিকল্পিত হোক বা শেষ মুহুর্তে সিদ্ধান্ত নেয়া হোক, পুরো প্রক্রিয়াটি খুবই গতানুগতিক এবং নির্দিষ্ট একটা পন্থা অনুসরণ করেই সম্পন্ন করা হয়।
এখানে সিজারের প্রতিটা ধাপ আলোচনা করা হলো-
প্রস্তুতি এবং অবশ করার মেডিসিন বা এনেস্থিসিয়া :
সিজারিয়ান সেকশন শুরু হয় অবশ করা এবং ক্যানোলা পরানোর মাধ্যমে। সাধারণত মেরুদণ্ডের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় অবশ করার মেডিসিন দেয়ার ফলে শরীরের নিচের অংশ সম্পূর্ণ অবশ হয়ে যায়। কিন্তু মা ঘুমিয়ে পড়বে না বা অচেতন হয়ে যায় না। এরপরে যদি প্রয়োজন হয় তবে মায়ের তলপেটের অংশ শেভ করা হয় এবং এন্টিসেপটিক দিয়ে ধুয়ে প্রস্তুত করা হয়। নার্স বা ডাক্তার মায়ের ব্ল্যাডারে ক্যাথেটার প্রবেশ করাবে এবং একটা পর্দা দিয়ে মায়ের বুক এবং পেটের অংশ আলাদা করে ফেলবে। মায়ের সাথে অপারেশন রুমে যে থাকবে তাকেও জীবাণুমুক্ত পোশাক পরানো হবে এবং সে মায়ের মাথার কাছে মায়ের হাত ধরে বসে থাকবে।
নার্স মায়ের তলপেটের সামনে একটা পর্দা দিয়ে দেয়, যাতে ঐ অংশ জীবাণুমুক্ত রাখা যায়। আর মাকে নিজের শরীরের কাঁটাছেড়া দেখতে না হয়। যদি মা নরমাল ডেলিভারির কিছুটা অভিজ্ঞতা নিতে চায় তাহলে পর্দা কিছুটা স্বচ্ছ/পাতলা থাকবে,অথবা একটা আয়না এমনভাবে বসানো হবে যেন মা তার সন্তানের জন্ম নেয়ার মুহুর্তটি দেখতে পায়। মা যদি নিজের শরীরের কাটাছেঁড়া দেখতে নাও চায়, শিশু জন্মের পরপর প্রথম মুহুর্তে অবশ্যই দেখতে চাইতে পারেন, সেক্ষেত্রে ডাক্তার বা সংশ্লিষ্ট কাউকে শিশুকে কয়েক মুহুর্তের জন্য উঁচিয়ে ধরতে বলতে পারেন।
যদি মা-কে ইমারজেন্সি সি সেকশন করাতে হয়, তাহলে অবশ করার মত যথেষ্ট সময় ডাক্তারদের হাতে নাও থাকতে পারে, (যদিও এরকম পরিস্থিতিতে পরার সম্ভাবনা খুবই কম) সেক্ষেত্রে এনেস্থিসিয়া দিয়ে অপারেশনের পুরোটা সময়ের জন্য মাকে সম্পূর্ণ অচেতন করে ফেলা হবে। চেতনা বা হুঁশ ফিরে পাবার পরে হয়তো মায়ের মাথা ঘুরবে,বা অস্থির হয়ে পড়বে বা বিচলিত হতে পারে। কিছুটা গলা ব্যথাও হতে পারে কারণ অপারেশনের সময় অক্সিজেন চলাচলের জন্য টিউব (endotracheal tube) গলার মধ্যে দেয়া হয়েছিলো।
শিশুকে যখন বের করা হবে তখন সামান্য টান বা চাপ ছাড়া অপারেশন চলা অবস্থায় মা কোনো ধরনের ব্যথা অনুভব করবে না। যদি পুরো শরীর অবশ করা না হয় তাহলে কোমরের নিচ থেকে বাকি অংশ অবশ অবস্থায় থাকবে। তার মানে হলো বাচ্চা পেট থেকে বের করার সময় মা জেগে থাকবে বা সজ্ঞান থাকবে।
পেট কাটা এবং ডেলিভারি:
শরীর সম্পূর্ণ অবশ বা পুরোপুরি অজ্ঞান করার পরে, নিচের অংশের লোম যেখান থেকে শুরু হয় তার ঠিক উপরের অংশে ডাক্তার ছোট একটা দাগের মত করে চামড়া কেটে ফেলে। যা অনেকটা জামাকাপড় বা ব্যাগের চেইন খোলার মত অনুভব হয়। ডাক্তারদের সুনিপুণ সেলাইয়ের পরে ক্ষত চোখে পড়ার সম্ভাবনা খুবই কম আর সময়ের সাথে সাথে সামান্য যে দাগ থাকবে তাও মিলিয়ে যাবে।এরপরে ডাক্তার মায়ের জরায়ুর নিচের দিকে কিছুটা কাটবে।এই দুই ধরণের কাটা বা ছেদনের জন্য দুই ধরনের পন্থা রয়েছে ( মায়ের পছন্দের দুইটি ধরন একরকম নাও হতে পারে)
- আড়াআড়িভাবে কাটা: ৯৫ ভাগ সিজারের ক্ষেত্রে জরায়ুর নিচের অংশ এই পদ্ধতিতে অর্থাৎ আড়াআড়িভাবে কাটা হয়,কারণ জরায়ুর নিচের অংশের মাংসপেশি অপেক্ষাকৃত পাতলা (এজন্য রক্তপাত কম হয়) এবং পরবর্তীতে নরমাল ডেলিভারির সময় এই অংশ ছিঁড়ে যাওয়ারও সম্ভাবনা থাকে।
- খাড়া বা লম্বাভাবে কাটা: বাচ্চা যদি জরায়ুর নিচের অংশ অথবা অন্য কোনো অস্বাভাবিক অবস্থায় থাকে কেবল তখনই জরায়ুর নিচে মাঝামাঝি অংশে লম্বভাবে সি সেকশনের জন্য কাটা হয়।
এরপরে যন্ত্রের সাহায্যে অ্যামনিওটিক ফ্লুইড বা পানি শুষে বের করে ফেলা হয়। এর ঠিক পরপরই শিশুকে মায়ের পেট থেকে বের করা হয়।
নরমাল ডেলিভারিতে জন্মনালী থেকে বের হওয়ার সময় শিশুর শ্বাসনালীতে থেকে যাওয়া শ্লেষ্মা বা কাশির মত ঘন একটা পদার্থ আপনাআপনিই বের হয়ে যায়। তবে সি-সেকশনে তা শিশুর শ্বাসনালীতে থেকে যায়। তাই শিশুর ছোট ফুসফুস দুটি পরিস্কার করার জন্য আরো কিছুটা সাকশন দরকার হয় যাতে ঘন শ্লেষ্মা সম্পূর্ণ বের হয়ে যায় এবং তার প্রথম কান্না শোনা যায়।
শিশুর সাথে প্রথম দেখা
নাড়ি কেটে ফেলার পর ডাক্তার মায়ের গর্ভফুল ( placenta ) বের করে ফেলবে আর নিয়মমাফিক জরায়ু বা অন্যান্য যেসব অঙ্গ সন্তান জন্মদানের সাথে সম্পর্কিত সেগুলো পরীক্ষা করে দেখবে যে ঠিকঠাক আছে কিনা।এরপর শরীরের সাথে মিশে যায় এমন সুতো দিয়ে জরায়ুর যে দিকটায় কাটা হয়েছিলো সে দিকটা সেলাই করে দেয়া হবে। এটা এমন সেলাই যা পরে আর কেটে বের করতে হয়না।
আর তলপেটেও একই রকম সেলাই বা স্ট্যাপল( এক ধরনের আধুনিক সেলাই যা করা খুবই সহজ) করে দেয়া হবে।
এরপর মা-কে ক্যানোলার মাধ্যমে এন্টিবায়োটিক দেয়া হবে যাতে ইনফেকশন না হয়।রক্তপাত নিয়ন্ত্রণের জন্য ও শরীরের সাথে জরায়ুর আবার সংযোগ স্থাপনের জন্য অক্সিটোসিন দেয়া হবে।এরপর নিয়মিত মায়ের রক্তচাপ, হৃৎস্পন্দন,শ্বাস প্রশ্বাসের পরিমাণ এবং কী পরিমাণ রক্তপাত হয়েছে তা মাপা হবে।এসব গুরুত্বপূর্ণ কাজ শেষে মা হয়তো সময় সুযোগ পাবেন তার জীবনে আসা নতুন মানুষটিকে আদর করার।
সিজারিয়ান সেকশনের পর কিছু মা অপারেশন রুমেই বা অপারেশনের পরে যে রুমে মাকে রাখা হয় সেখানেই বাচ্চাকে বুকের দুধ পান করাতে পারে। কিন্তু মা যদি বেশি ক্লান্ত হয়,তাহলে দুশ্চিন্তার কিছু নেই, পরে যথেষ্ট সময় পাওয়া যায় সন্তানের সাথে সময় কাটানোর, আদর করার। তাছাড়া শিশুকে যদি NICU (neonatal intensive care unit) বা নবজাতকের বিশেষ খেয়াল রাখার জায়গাতে নিতে হয় তাহলেও ভয়ের কিছু নেই।সি সেকশনের পরে কিছু হাসপাতাল নিয়ম পালনের জন্যই এমনটা করে থাকে। এটা শিশুর সমস্যা আছে বলেই যে করা হয় তা নয় বরং শিশুর যাতে কোনো সমস্যা না হয় সেই দিকটা দেখার জন্যই করা হয়।
সিজারের সময় কী কী সমস্যা হতে পারে
সিজারিয়ান সেকশন নিরাপদ জন্মদান পদ্ধতি। তবে মাঝে মাঝে কিছু জটিলতা সৃষ্টি হতেও পারে। হতে পারে ঔষধের প্রতিক্রিয়া অথবা এনেস্থিসিয়া বা অপারেশনের সময় যে ঔষধ দিয়ে শরীর অবশ করা হয়েছিলো তার প্রভাব। রক্তক্ষরণ কিংবা ব্যথার জায়গায় ইনফেকশনও হতে পারে। এসব কারণেই ডাক্তারের নির্দেশনা সতর্কতার সাথে অনুসরণ করা উচিত।
কখনো কখনো মায়ের শরীরে ( পা/মেরুদন্ডের নিচে/ নিতম্বের মাঝামাঝি অংশে এমনকি ফুসফুসে) রক্ত জমাট বাঁধতে পারে।এমন যেন না হয় সেজন্য ডাক্তার অবশ্যই ব্যবস্থা নেবেন কিন্তু অপারেশনের পর যত দ্রুত হাঁটাচলা শুরু করা যায় তত ভালো। সি-সেকশনের সময় যদি কোনো অঙ্গ (bowel or bladder) ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে আরো কিছু সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে।
যদিও খুব কমই এমন হয় তবুও জেনে রাখা ভালো যে জরায়ুর মধ্যে মাঝেমাঝে জ্বালাপোড়া বা চুলকানি অনুভব হতে পারে। যাকে এন্ডোমেট্রাইটিস (endometritis) বলে। মা যদি পেলভিক এরিয়ায় (মেরুদণ্ডের নিচে, নিতম্বের উপরের অংশে) ব্যথা অনুভব করেন, বা অস্বাভাবিক হারে স্রাব বা কিছু বের হয় অথবা জ্বর হয়ে থাকে তাহলে যত দ্রুত সম্ভব ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।
শিশু যদি সি সেকশনের মাধ্যমে জন্ম নেয় তাহলে ক্ষণস্থায়ী ট্যাকিপনিয়া ( দ্রুত শ্বাসপ্রশ্বাস নেয়ার নেয়ার প্রবণতা যা শিশুর ফুসফুসে কিছু পানি থেকে যাওয়ার কারণে হতে পারে) হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। শুনতে খুবই ভয়ানক মনে হলেও এই সমস্যা জন্মের পর সাধারণত একদিন থাকে তারপর আপনাআপনি সেরে যায়।
এছাড়া মায়ের সি-সেকশন যদি ৩৯ সপ্তাহের আগে হয়ে থাকে তাহলে শিশুর শ্বাসপ্রশ্বাসে কিছু জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায় কারণ তখনো হয়তো তার ফুসফুস শ্বাস নেয়ার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হয়নি।
ভয়ের কিছু নেই,এক্ষেত্রে ডাক্তার শিশুকে খুবই সতর্কতার সাথে নজরে রাখবেন এবং যে কোনো সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবেন।
এটা সবাই জানে যে প্রতিবার সিজারিয়ান সেকশনের পর শারীরিক জটিলতা বাড়তে থাকে।
যদিও কতবার সি-সেকশন করানো নিরাপদ তার কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই, ডাক্তাররা তিনবার সিজারিয়ান সেকশন করানোর পর নরমাল ডেলিভারির চেষ্টা করতে নিষেধ করেন।তাই একজন মা যদি তিনবার সি-সেকশনের পর চতুর্থ সন্তানের মা হতে চান তাহলে নরমাল ডেলিভারির চিন্তা করা উচিত হবে না
সিজার করা ভালো নাকি নরমাল ডেলিভারি ভালো
আমেরিকার প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ সংস্থা (AGOC) এর সাম্প্রতিক নির্দেশনা হলো–
মা এবং ডাক্তার যেন সবসময় নরমাল ডেলিভারির জন্য চেষ্টা করে।
যতক্ষণ না পর্যন্ত শারীরিক জটিলতার কারণে সিজারিয়ান সেকশন করাতে বাধ্য হয় ততক্ষণ নরমাল ডেলিভারির চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।।যদি মা এবং শিশু উভয়ই শারীরিকভাবে সুস্থ এবং নরমাল ডেলিভারির জন্য প্রস্তুত থাকে তাহলে অযথা কোনো চিকিৎসা বা অন্য কোনো পদ্ধতি প্রয়োগ না করাই ভালো।এতে মা নিরাপদ ও স্বাভাবিক জন্মদান প্রক্রিয়ার স্বাদ পায়।
যারা পরিকল্পনা করে সি সেকশন করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাদেরকে ৩৯ সপ্তাহের আগে সিজার না করানোর পরামর্শ দিয়েছে AGOC ।ডাক্তারেরা যেন সি-সেকশনের ঝুঁকিপূর্ণ দিক এবং পরবর্তী জটিলতাগুলো অবশ্যই গর্ভবতী মায়েদের মনে করিয়ে দেন। যেমন- গর্ভফুল নিচের চলে যাওয়া বা জরায়ুমুখে লেগে থাকা, জরায়ু থেকে গর্ভফুল আলাদা না হওয়া,এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে জরায়ু কেটে ফেলার মত ঘটনা। একবার সিজারিয়ান সেকশন করালে পরেরবারও সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমেই সন্তান জন্মদানের আশংকা বেড়ে যায় এটাও যেন মায়েরা মনে রাখে।
সিজার করানো যেহেতু সহজ এবং ব্যথাহীন তাই কিছু গর্ভবতী মা আগে থেকেই নরমাল ডেলিভারির পরিবর্তে সি সেকশন করানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, বিশেষত যারা আগেও সি সেকশন করিয়েছেন। নানান ধরনের সচেতনতামূলক প্রচার প্রচারণার কারণে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে সিজার করানোর প্রবণতা বর্তমানে কমে গেছে।
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা নরমাল ডেলিভারি করতে উৎসাহ দেন,দরকার হলে ভ্যাকিউম দিয়ে বাচ্চা বাইরে টেনে আনার কথা বলেন এবং ফোরসেপস্ বা চিমটা ব্যবহার করতে বলেন,তবুও যাতে সিজার করা বা কোনো অপারেশন করতে না হয়।
এছাড়াও তারা প্রসব বেদনার সময় মাকে সময় দিতে বলেন যাতে মা নিজে নিজেই চাপ দিয়ে বাচ্চা বের করতে পারেন,এবং প্রসববেদনা বন্ধ হয়ে গেলে পিটোসিন দিয়ে যাতে আবার প্রসববেদনা শুরু করাতে বলেন।অন্তত যতক্ষণ পর্যন্ত সিজার না করিয়ে পারা যায় ততোক্ষণ অন্যান্য সব স্বাভাবিক পদ্ধতি অবলম্বন করতে বলেন।
মানুষ এটাও বুঝতে শুরু করেছে যে যদিও সিজার করা যথেষ্ট নিরাপদ একটা পদ্ধতি, তবুও এটা একটা বড় ধরনের অপারেশন যা মোটেও ঝুঁকির বাইরে না।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো,যদি নরমাল ডেলিভারির সুযোগ থাকে বা শারীরিক অবস্থা উপযুক্ত থাকে তখন সিজার কখনোই ‘মা চাইছে’ বলে হওয়া উচিত নয়। আপনার সন্তান যখন পুরোপুরি প্রস্তুত, তখনই তাকে পৃথিবীতে আনার সবথেকে উপযুক্ত সময়।আর সিজার যখন আগে থেকেই পরিকল্পনা
করে করা হয়, তখন অসাবধানতাবসত সময়ের আগেই শিশু জন্ম হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
আগে থেকে পরিকল্পনা করে সিজার করাবেন কিনা এখনো ভাবছেন?
যদি এরকম চিন্তা করে থাকেন নিচের প্রশ্নগুলো আগে নিজেকে করুন এবং আপনার চিকিৎসকের সাথে কথা বলুন,যাতে আপনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন আপনার এবং আপনার শিশুর জন্য কোনটি সবচেয়ে ভালো হবে।
*আপনি কি প্রসববেদনা ভয় পান?
যদি প্রসববেদনা আপনার ভয়ের কারণ হয়ে থাকে তাহলে জেনে রাখুন অধিকাংশ নারীই এই ভয় পেয়ে থাকে।কিন্তু নরমাল ডেলিভারির ক্ষেত্রে প্রসববেদনা কমানোর জন্য খুবই কার্যকরী কিছু ওষুধ রয়েছে যেমন এপিডিউরাল।
*আপনি কি নরমাল ডেলিভারির পরে প্রস্রাবে নিয়ন্ত্রণ না থাকার ব্যাপারে চিন্তিত?
এটা সত্য যে নরমাল ডেলিভারির পর প্রস্রাবের নিয়ন্ত্রণ কমে যাওয়া বা অনিচ্ছাকৃত প্রস্রাব বের হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। কিন্তু কেগেল এক্সারসাইজ এই ঝুঁকি কমিয়ে দেয়। কেগেল এক ধরনের ব্যায়াম যা পেলভিক ফ্লোর বা প্রস্রাবের সাথে সম্পর্কিত পেশিকে শক্তিশালী করে।
*ভবিষ্যতে কি আপনি আরো সন্তান নিতে চান?
মনে রাখবেন প্রথমবার সিজার করানোর কারণে পরবর্তীতে নরমাল ডেলিভারি আপনার জন্য কঠিন হয়ে পড়বে।যদিও যোনীপথে জন্মদান বা নরমাল ডেলিভারি সিজারের পরেও নিরাপদ কিন্তু সিজারের সময় যাদের তলপেট আড়াআড়ি কাটা হয়েছে তাদের ক্ষেত্রেই নিরাপদ।তাছাড়া একবার সিজার করানোর পর ভবিষ্যতে মা হতে গেলে গর্ভফুলে জটিলতা তৈরি হয়।
সিজারের পর সুস্থ হতে কতদিন লাগে
সন্তান জন্মের পর মায়ের ইচ্ছা করবে তাকে কাছে পাওয়ার,আদর করার।কিন্তু সেজন্য মাকে অপেক্ষা করতে হবে।নরমাল ডেলিভারির তুলনায় সিজারের পর শরীর সুস্থ হতে সময় একটু বেশি লাগে।পুরোপুরি সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য সিজারিয়ান সেকশনের পরে তিন থেকে চারদিন হাসপাতালে থাকতে হবে এবং চার থেকে ছয় সপ্তাহ সময় ঘরে বিশ্রামে থাকতে হবে।
সিজারের পর সাধারনত তিন চারদিন হাসপাতালে থাকতে হয়,কিন্তু কারো কারো ক্ষেত্রে বেশি সময় লাগতে পারে।যদি সিজারের সময় সমস্যা কারো বেশি থাকে তাহলে সুস্থ হতে সময়ও বেশি লাগবে আর সমস্যা কম থাকলে সময়ও কম লাগবে।
দুটি বিষয় নিশ্চিত না হওয়ার আগে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফেরা যাবেনা।
প্রথমত পায়খানা ঠিকমতো হচ্ছে কিনা বা স্বাভাবিক আছে কিনা
দ্বিতীয়ত স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা
সিজারের পর তাড়াতাড়ি সেরে ওঠা যায় কিভাবে
সিজারের পর ডাক্তার কিছু পরামর্শ দিয়ে থাকে দ্রুত সেরে ওঠার জন্য।সবকিছুতে শান্তভাব বজায় রাখা,তাড়াহুড়ো না করাই সুস্থ হয়ে ওঠার মূল রহস্য।পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার আগে এমন কোনো কাজ করা যাবেনা যাতে সেলাইয়ে টান লাগে। বেশি পরিশ্রমের কারণে ক্লান্ত হয়ে পড়তে হয় এমন কোনো কাজও করা যাবেনা।এই পরামর্শ না মানলে স্বভাবতই সুস্থ হতে স্বাভাবিকের থেকে সময় অনেক বেশি লাগবে।সুতরাং সুস্থ হওয়ার জন্য এই কৌশলগুলো মাথায় রাখা জরুরি।
প্রত্যাশা কমানো
সিজারিয়ান সেকশনের পরে নানান শারীরিক সমস্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, নরমাল ডেলিভারির পরে যেমন ঠিক তেমনই।
আরো পড়ুন: সন্তান হবার পরে যা ঘটে
অপারেশনের কারণে এবং ঘুম কম হওয়ার কারণে মা হওয়া পরে অবসাদ বা ক্লান্তি, জরায়ু সংকোচনের কারণে ব্যথা হওয়া (যা মাসিকের সময় এবং গর্ভকালীন সময়ে হয়ে থাকে) মা হওয়ার পরে স্বাভাবিক রক্তপাত বা স্রাব হওয়া( যা লোচিয়া নামে পরিচিত), সিজার করানোর আগে যদি নরমাল ডেলিভারির জন্য চেষ্টা করা হয় তাহলে এক ধরনের ব্যথা হয়ে থাকে যা পেরিনিয়াল ব্যথা নামে পরিচিত। স্তনে দুধের পরিমাণ বেশি হওয়ার কারণে স্তন ফোলা বা শক্ত হওয়া, ব্যথা করা এবং হরমোন বেড়ে যাওয়া। এই বাড়তি হরমোনের কারণে মায়ের চামড়া শুষ্ক হতে পারে, চোখে ঝাপসা দেখতে পারে। সবসময় অবসাদগ্রস্ত থাকা এবং হাত পায়ের জয়েন্টে ব্যথা হওয়ার মতো সমস্যাও হতে পারে।
এসব সমস্যা একসময় কেটে যাবে কিন্তু তার জন্য ধৈর্য্যের সাথে সময় নিয়ে অপেক্ষা করতে হবে।
সতর্ক থাকা
আপনার ক্ষত অন্তত কয়েক সপ্তাহ ব্যথা করবে,তাই শুধুমাত্র শিশুকে ছাড়া সব ধরনের জিনিসপত্র ওঠানো নামানো বা বহন করা বন্ধ রাখুন।শিশুকে আদর করার সময় বা যত্ন নেয়ার সময়, ক্ষত জায়গায় যাতে আঘাত না লাগে সেজন্য বালিশ কোলে নিয়ে নিতে হবে এবং কোনো অবস্থাতেই শিশুকে কোলে নিয়ে হাঁটাচলা করা বা বহন করা যাবেনা।
কাজ থেকে বিরত থাকা
হ্যাঁ আপনার নিজের সন্তানের যত্ন নিতে হবে,কিন্তু সেই সাথে আপনার নিজের শরীরেরও যত্ন নিতে হবে।তাই অন্য কেউ, যেমন- আপনার স্বামী,পরিবারের অন্য লোকদের বা বন্ধুদেরকে সুযোগ দিন বাচ্চাকে আপনার কাছে নিয়ে আসার। সবসময় নিজেকেই উঠে বাচ্চার খেয়াল রাখতে হবে এমন না।এবং খাবার দাবাড় যোগাড় করা আর কাপড়চোপড় ধোয়া সহ অন্যান্য কাজে পরিবারের অন্যান্য সদস্যের সাহায্য নিন।
পেটের ক্ষতর দিকে সর্বাত্মক নজর রাখা
সিজারের কারণে তৈরি হওয়া ক্ষত দ্রুত সারানোর জন্য ক্ষত সবসময় পরিষ্কার রাখতে হবে (ডাক্তার যেভাবে করতে বলে সেভাবে)।ঢিলেঢালা সুতির পোশাক পরতে হবে যাতে পেটের সাথে লেগে না থাকে এবং ঘষা না লাগে।ব্যথার চারপাশে চুলকানো এবং টান লাগা, অবশভাব হওয়া খুবই স্বাভাবিক এবং তা সময়ের সাথে সাথে মিলিয়েও যাবে।অবশ্য মিলিয়ে যাওয়ার আগে ক্ষত জায়গা কিছুটা গোলাপী/ বেগুনি রঙের হয়ে যায়।যদি মায়ের জ্বর হয়,প্রচন্ড ব্যথা হয়, ক্ষত লাল হয়ে যায় এবং কিছুটা পানির মত বের হয়,তাহলে বুঝতে হবে এখানে ইনফেকশন হয়েছে।যদিও কাটা জায়গা থেকে অল্প পরিমাণ পানির মত বের হওয়া স্বাভাবিক, তবুও তা ডাক্তারকে তৎক্ষণাৎ জানাতে হবে।
ওষুধ পথ্য
ব্যথা কমানোর ওষুধ খাওয়া শুরু করতে হবে অপারেশন হওয়ার পরপরই।যদি শিশু মায়ের বুকের দুধ পান করে সেক্ষেত্রে ডাক্তার আপনাকে নির্দিষ্ট ধরনের ঔষধ দেবে যা নিরাপদ।
চাপ লাগে এমন জিনিস থেকে দূরে থাকা
পেটে গ্যাস তৈরি হলে ব্যথার জায়গার চামড়ায় টান লাগতে পারে এবং অস্বস্তি হতে পারে,এবং অবশ করার জন্য যে ওষুধ দেয়া হয়েছিলো তা ভেতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যক্রম কিছুটা ধীরগতি করে দিতে পারে। যেসব খাবার খেলে “আপনার” পেটে গ্যাস হয় সেসব খাবার এই সময়ে খাওয়া যাবেনা।
সঠিক খাবার নিয়মিত খাওয়া
সন্তান নরমাল ডেলিভারিতে হোক বা সিজারের মাধ্যমেই হোক শিশু জন্মের পরপরই মায়ের কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। তাই পায়খানা করার সময় একদমই চাপ দেয়া যাবেনা।তার বদলে ফাইবার/আঁশ সমৃদ্ধ খাবার যেমন বাদাম,গমের রুটি,জাম,ব্রকোলি, বাদাম,শুকনো ফল,বিভিন্ন ডাল,আলু ইত্যাদি খাবার খেতে হবে এবং প্রচুর পরিমাণে তরল খাবার বা পানি পান করতে হবে।ডাক্তার হয়তো আপনাকে পায়খানা নরম করার বা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে এমন ওষুধ দিতে পারে। তবে প্রতিদিন টক দই ও ইসুবগুলের ভুষি খেয়ে দেখতে পারেন। কোষ্ঠকাঠিন্য একদম দূর হয়ে যাবে।
পুষ্টিমান সম্পন্ন খাবার খাওয়া
নিজের স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য মানসম্মত নাস্তা এবং পানি সবসময় হাতের কাছে রাখতে হবে। ভালো জিনিস বাছাই করতে হবে যেমন বাদাম বা ফল।যেসব খাবার খেলে মায়ের গ্যাস বা কোষ্ঠকাঠিন্য হয় তা খাওয়া যাবেনা।
শরীর সচল রাখা
সন্তান জন্মের পর কিছু ব্যায়াম করতে হয়, কিন্তু সেগুলো ক্ষত শুকানোর আগে নয়।ডাক্তার যখন করার জন্য বলবে ঠিক তখনই এগুলো শুরু করা যাবে।কিন্তু হার্ড এক্সারসাইজ শুরু করার আগেই শুয়ে থাকা অবস্থাতেই শরীর দ্রুত সেরে ওঠার জন্য কিছু কাজ করতে হবে যাতে রক্ত সঞ্চালন বাড়ে এবং পেশি সচল থাকে।শুরুর দিকে পা টান টান রাখা এবং পা নাড়ানো চাড়ানো,পায়ের পিছনের দিকের পেশিকে লম্বাভাবে চাপ দেয়া বা আঁকাবাকা করে নাড়ানো এবং পা চারদিকে ঘুরানো।এগুলা করা যখন সহজ মনে হবে তখন বাড়ির ভেতরেই হাঁটাচলা শুরু করতে হবে। যা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে এবং যাতে গ্যাস নাহয় সেজন্যও সাহায্য করবে। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত লাগলে বসে পড়ুন।কিন্তু প্রতিদিন যতক্ষণ সম্ভব হাঁটাচলা করে শারীরিক সক্ষমতা বাড়ান।
সিজারের কতদিন পর সহবাস করা যায়
সিজারের পর কমপক্ষে চার থেকে ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত যৌন মিলন বা অন্য কোনো পদ্ধতিতে যোনীপথে কিছু প্রবেশ করানো যাবেনা। বাংলাদেশে অন্তত দেড়মাস সহবাস থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়।
তবে একেকজনের শরীর একেকরকম। কারো কারো ক্ষেত্রে আরো বেশি সময় লাগতেই পারে। সিজারের পর হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নেওয়ার সময়ে আপনার ডাক্তারের সাথে এই বিষয়ে আলোচনা করে নিন এবং কোনো বিশেষ বিধিনিষেধ আছে কিনা তা জেনে নিন।সিজার করা পরে মাকে অবশ্যই নিয়মিত ডাক্তার দেখাবেন। এবং সহবাসের আগে শিশুর বাবা-মা দুজনেই এ নিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে নিরাপদ পরিবার পরিকল্পনা করে নিলে সবচেয়ে ভালো। সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর সহবাস করা নিয়ে শারীরিক কিংবা মানসিক অস্বস্তি হলে সঙ্গীর সাথে খোলাখুলি আলোচনা করুন। সময় নিন।
সন্তান জন্ম দেবার পরের সময়টা বেশ কঠিন। আপনার নিশ্চয়ই আগের জীবন ফিরে পেতে মন চাইবে কিন্তু মায়ের প্রতি আপনাকে সদয় হতে হবে। যখনই সম্ভব হয় মাকে বিশ্রাম দিন। পুষ্টিকর খাবার ও বিশ্রাম পেলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবেন। তখন সব কাজ ভালোভাবে করতে পারবেন।
সিজার করলে পরে কী কী সমস্যা হতে পারে
সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে বাংলাদেশে অপ্রয়োজনীয় সি-সেকশনের সংখ্যাই বেশি। ২০২৩ সালে নরমাল ডেলিভারির পক্ষে ব্যাপক প্রচারণা এবং অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান সেকশন রোধে গাইডলাইন চূড়ান্ত করে ব্যাপকভাবে প্রচার করতে নির্দেশ দেয় বাংলাদেশের আদালত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন বলে কোনো দেশেই শতকরা ১০ থেকে ১৫ শতাংশের বেশি সি-সেকশন “প্রয়োজনীয়” হতে পারে না। বাংলাদেশে এর হার বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ৮৩ শতাংশ ও সরকারি হাসপাতালে ৩৫ শতাংশ। এনজিও হাসপাতালগুলোতে ৩৯ শতাংশ সি-সেকশন হয়।
আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’ তাদের প্রতিবেদনে কয়েকটি উদ্বেগের কথা তুলে ধরেছে।
১. সিজারের কারণে সন্তান জন্মদানে বাবা-মাকে ব্যাপক খরচের ভার বহন করতে হচ্ছে।
২. মা ও শিশু উভয়কেই এমন অস্ত্রোপচার ঝুঁকিতে ফেলে।
৩. জন্মের সময় অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের ফলে ইনফেকশন ও মাত্রাতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, রক্তজমাট, অঙ্গহানিসহ নানা কারণে মায়ের সুস্থ হতে নরমাল ডেলিভারির চেয়ে বেশি সময় লাগে।
৪. নরমাল ডেলিভারি প্রক্রিয়াতে মায়ের শরীর থেকে বের হওয়ার সময় শিশুর শরীর ভালো ব্যাকটেরিয়া গ্রহণ করতে পারে। এসব ব্যাকটেরিয়া শিশুর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে। সি-সেকশনের সময় শিশু এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে পারে না। যার ফলে এই ভালো ব্যাকটেরিয়া সে পায় না।সি-সেকশনে জন্ম নেয়া শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এজন্য তুলনামূলক কম হতে পারে।
৫. বুকের দুধ পান করার জন্য মায়ের সঙ্গে শিশুর যে শারীরিক নৈকট্যে আসা দরকার সিজারিয়ান হলে সেটি প্রয়োজনের তুলনায় দেরিতে ঘটে। কারণ মায়ের সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য শিশুকে তখন কিছু সময় দূরে রাখা হয়।
একদম শুরুর দিকে মায়ের বুকের দুধ বা শালদুধের দারুণ উপকারিতা রয়েছে। তা থেকে শিশু বঞ্চিত হয়।
আরো পড়ুন: কিভাবে বুকের দুধ খাওয়ানো ভালো?
২০১৮ সালে বাংলাদেশি বাবা-মায়েরা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানে খরচ করেছেন প্রায় চার কোটি টাকার বেশি। জনপ্রতি গড়ে তা ছিল ৫১ হাজার টাকার বেশি। সিজারিয়ানে সন্তান জন্মদানের হার বাংলাদেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে মারাত্মক হারে বেশি।
বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে যত শিশু জন্ম নেয় তার ৮০ শতাংশই হয় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে।
সংস্থাটি আরও বলছে, ২০১৮ সালে যত সিজারিয়ান হয়েছে তার ৭৭ শতাংশই চিকিৎসাগতভাবে অপ্রয়োজনীয় ছিল। কিন্তু তারপরও এমন সিজারিয়ান হচ্ছে।
সেভ দ্য চিলড্রেন এমন অপ্রয়োজনীয়ে সি-সেকশন বন্ধ করতে ডাক্তারদের ওপর নজরদারির পরামর্শ দিয়েছে। এমন প্রবণতার জন্য সংস্থাটি আংশিকভাবে বাংলাদেশের চিকিৎসা সেবাখাতের অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করছে।